• ঢাকা, শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫

হকি উন্নয়নে কর্মকর্তাদের দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে

ফুটবলের পর একটা সময় হকিও দারুণ জনপ্রিয় খেলা ছিল। সেসময় ক্রিকেটও এতো জনপ্রিয় ছিল না। কিন্তু কালের আর্বতে হারিয়ে যাওয়া সেই জনপ্রিয় খেলাটা এখন কোথায় এসে ঠেকেছে, ভেবে দেখেছেন কী? কিংবা যখন যারা ফেডারেশনের কর্মকর্তা হয়ে এসেছেন তখন তারা হকি উন্নয়নেই বা কতটা আন্তরিক ছিলেন- এমন প্রশ্ন করা যেতেই পারে। এখন তো হকি বলতে বিকেএসপিকেই বোঝায়! জাতীয় দল বলুন আর জুনিয়র দল বলুন- এই সংস্থাটি না থাকলে হকির কি দর্শা হতো ভাবা যায়!

অথচ যখন বিকেএসপি ছিল না, তখন তো এদেশের হকির রমরমা অবস্থা ছিল। দেশজুড়ে খেলা ছিল। নিয়মিত লিগ হতো। মানসম্পান্ন খেলোয়াড় ছিল। আর এখন আগের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবার পরও কেনো জাতীয় পর্যায় খেলা নেই, নিয়মিত লিগ নেই, কেনোই বা হকির এই দুরবস্থা? তাহলে কর্মকর্তারা কমিটিতে এসে করেনটা কী?

যখন যারা ফেডারেশনের কমিটি আসেন তখন কর্মকর্তারা হকির সুদিন ফিরিয়ে আনতে কতই না মুখে মুখে আশ্বাসের ফিরিস্তি দিয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে তলানিতেই পড়ে আছে এদেশের সম্ভাবনাময় এই খেলাটি। নব্বই দশকের পর হকির জনপ্রিয়তা এখন কোথায়? একবারও কি আমরা ভেবে দেখেছি। এমন প্রশ্নে তো এখন কর্মকর্তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেতেই পারে।

বরাবরই আমরা দেখে আসছি ফেডারেশনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক আর হাতে গোনা মুষ্টিমেয় ক’জন হকি উন্নয়নে কাজ করেন। বাকিরা থাকেন বোঝা হয়ে। তারা না পারেন কোনো স্পন্সর আনতে, না পারেন কোনো দিক-নির্দেশনা দিতে। তাহলে ২৯ সদস্যের এ কমিটিতে তাদের রেখেই লাভ কি?

আগামী ৫ মে হকি ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। তাই দুয়ারে আরেকটি নির্বাচন কড়া নাড়ছে। ইতোমধ্যে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে কমিটিতে থাকতে অনেকে দৌড়ঝাপ শুরু করে দিয়েছেন। তবে আমরা আশা করবো, যারা নীতিনির্ধারক রয়েছেন তারা যেনো অতীতের মতো ভুল না করেন। যারা কমিটিতে আসার যোগ্য এমন কর্মকর্তারাই যেনো কমিটিতে জায়গা পান- সেদিকে বিবেচনা করবেন। হকিকে বাঁচাতে হলে অন্তপ্রাণ সংগঠকের বিকল্প নেই।

ভাবতে অবাক লাগে সঠিক দিক-নির্দেশনার অভাবে দিন দিন হকির পকেটগুলো ক্রমশ: বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শত ঐতিহ্যের সূতিগার আরমানীটোলা স্কুল হকি উন্নয়নে এক সময় বিরাট ভূমিকা রেখেছে। সেখানে এখন হকিটা কি অবস্থায় চলছে তা তো দেখাই যাচ্ছে! অথচ এই স্কুলের অনেক কৃতী খেলোয়াড় এদেশের হকিকে জনপ্রিয় করে তুলতে এবং দেশজুড়ে হকি খেলোয়াড় সৃষ্টিতে বিশেষ অবদান আমরা ক;জনই বা মনে রেখেছি। অপ্রিয় হলেও সত্যি স্কুল পর্যায়ে হকির পৃষ্ঠপোষকতা এবং চর্চা এখন প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে।

যেখানে স্বাধীনতার পর দেশজুড়ে হকির চর্চা এবং পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধি পাবার কথা ছিল, সেখানে ক্রমশ: হকির পরিসর আরো ছোট্ট হয়ে যাচ্ছে এবং সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। এ ধরনের বাস্তবতার মধ্যে হকিকে ঘিরে কি-ই-বা আশা করা যায়? শুধু একটা বিকেএসপি জাতিকে স্বপ্নের রাস্তা চিনিয়ে দেবে তা কি করে সম্ভব?

আন্তস্কুল ও আন্তকলেজ হকির এখন করুণ অবস্থা। ঢাকাই লিগও নিয়মিত নয়। জাতীয় হকি প্রতিযোগিতারও একই দর্শা। দেশজুড়ে আগের মতো জমজমাট সেই হকিটাও নেই। বিশেষ করে হকির কমিটিতে যারা কর্মকর্তা বনে আসেন তাদের সাংগঠনিক অদক্ষতা, ব্যর্থতা এবং জবাবদিহিতা নেই বলেই আজ খাদের কিনারায় এসে ঠেকেছে ঘরোয়া হকি।

নবাব পরিবারের বদৌলতে এদেশের মাটিতে এ খেলাটির ইতিহাস শত বছরেরও পুরনো। ইংরেজ শাসনামল পরবর্তী পশ্চিম পাকিস্তানের সময় বাঙালি খেলোয়াড়রা বৈষম্য আর অবহেলার স্বীকার হলেও এই হকিকে ঘিরেই সেসময় একটা ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল। এরপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশে ফুটবলের পর হকির জনপ্রিয়তা ছিল দেখার মতো। এমন কী, আশির দশকে বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তান জাতীয় দলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জাতীয় দল ঢাকায় যেভাবে লড়েছিল তা কখনো ভোলার মতো নয়।

সম্ভাবনাময় এই খেলাটির চর্চা এবং পৃষ্ঠপোষকতায় কেনো ভাটা পড়লো, ঢাকায় আগে যেখানে নিয়মিত লিগ, টুর্নামেন্ট হতো সেটা কেনো অনিয়মিত, বিভিন্ন জেলায় লিগ-টুর্নামেন্ট হতো সেটাই বা কেনো নিয়মিত হচ্ছে না- এমন হাজারো প্রশ্ন সবার মনে। এমন কি, সার্ভিস দল ও স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো যারা এক সময় হকির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল তারাই বা কেনো উৎসাহ-আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে- এসব নিয়ে কর্মকর্তারা কখনো ভাবতে চাননি কিংবা এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি। সমস্যাকে সবসময়ই তারা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করায় বাস্তবতা আজ এই অবস্থায় দাঁড়িয়েছে।

বিশেষ করে হকির প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত না করায় এবং সমাধানের দিকে নজর না দেওয়ায় মূলত খেলাটির উন্নতি কাঙ্খিত পর্যায় পৌঁছুতে পারেনি। কর্মকর্তারা শুধু গদি টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন স্বপ্নের কথা শুনিয়ে সময় কাটিয়েছেন। কখনো তারা পরিকল্পিকভাবে হকিতে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা না করায় ঘরোয়া হকিকে এখন খেসারত দিতে হচ্ছে।

অথচ হকিকে বিশ্বপরিসরে মেলে ধরতে সরকার দেশে হকি স্টেডিয়াম নির্মাণ করে দিয়েছে। হকির আধুনিক অ্যাস্ট্রোটার্ফ স্থাপন করেছে। ফ্ল্যাডলাইটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বছর বছর অনুদান বৃদ্ধি করছে। অনেক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপরও কেনো এদেশের হকি এগোচ্ছেনা সেটাই এখন বড় প্রশ্ন!

দেশে বিভিন্ন সময়ে নানারকম এশীয় পর্যায় টুর্নামেন্ট হয়েছে। প্রথমবারের মতো বিদেশী তারকাদের সমন্বয়ে ফ্রাঞ্চাইজি লিগও হয়ে গেলো।
কিন্তু বাংলাদেশের হকির প্রাপ্তি কি? খেলা হিসেবে হকিকে অনুপ্রাণিত এবং উৎসাহিত করা কি সম্ভব হয়েছে, নাকি দেশব্যাপী হকির চর্চা বৃদ্ধি পেয়েছে? এমন কি, ১৮ কোটি মানুষের এই দেশে ৩৪ জন ভাল খেলোয়াড় নেই- যাদের নিয়ে জাতীয় দলের ক্যাম্প ডাকা যায়!

কিন্তু সবসময়ই হকি উন্নয়নে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে, এখনো আসছে, ভবিষৎতেও আসবে। খেলাটির উন্নতি কল্পে
এ পর্যন্ত পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, জার্মানি, মালয়েশিয়া থেকে কোচও এসেছেন। ভবিষৎতেও আসবেন। দলের দক্ষতা অর্জনে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে যাচ্ছে জাতীয় দল। কিন্তু ফলাফল কি দেখছি? কখনো কি ভাবা হচ্ছে হকির রাত পোহাতে আর কতো সময় লাগবে?

অবস্থাদৃষ্টে কিন্তু হকির উন্নয়নে অনেক সময় কর্মকর্তারাই বড় বাধা হয়ে উঠেছেন। তাদের কারণে বিদেশী কোচরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেননি- এমন অভিযোগ নতুন নয়। তাদের পছন্দের কাউকে জায়গা করে দিতে অযথা হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। এমন কি এ নিয়ে কোচ-কর্মকর্তার অন্তদ্বন্দ্ব কম হয়নি। শুধু তাই নয়! কর্মকর্তাদের দেশী কোচদের উপর আস্থা এবং বিশ্বাসের অভাব রয়েছে।

আমি মনে করি, সবার যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্ব এক নয়। তারপরও যোগ্য এবং দক্ষ দেশী-বিদেশী কোচদের কর্মকর্তারা সেভাবে মূল্যায়ন করতে পারেননি। ক্রীড়াঙ্গনে টেকনিক্যাল পারসনদের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু পদে পদে ননটেকনিক্যালদের অযথা হস্তক্ষেপই হকিকে বারবার শুধু পিছিয়েছে। কাজেই আর নয়। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। অন্যরা এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা পিছিয়ে পড়ছি। কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব, আন্তরিকতার ঘাটতি এবং পরিকল্পিত উদ্যোগের অভাবই হকি খুব একটা এগোতে পারছে না। সামনে হকির নির্বাচন। আমরা চাই যোগ্য, কর্মঠ আর টেকনিক্যাল ব্যক্তিবর্গ নিয়েই কমিটি হোক। ক্রীড়াঙ্গনের নীতিনির্ধারক যারা রয়েছেন আশা করি বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন।

লেখক : জাতীয় হকি দল ও আবাহনীর সাবেক খেলোয়াড়

 

 

 

Rent for add